নারী তুমি কার? তোমার না তার?
প্রকাশিত: দুপুর ০১:৪৭; রবিবার ; ১৮ অক্টোবর, ২০১৫ | সম্পাদিত: রাত ১০:৪৪; রবিবার ; ১৮ অক্টোবর, ২০১৫
তসলিমা নাসরিন॥
সেকালে এভাবে ছোটখাটো এটাসেটার প্রতিবাদ করতাম আমি।
১.
লিফটে মেয়ে উঠলে লিফটম্যান মেয়েদের একটি কোনা দেখিয়ে বলে- ‘এখানে দাঁড়ান’। কোনায় দাঁড়াতে বলে, কারণ পুরুষেরা যেন মেয়েদের গা ঘেঁষে না দাঁড়ায়। গা ঘেঁষে দাঁড়ালে তারা ফাঁকফোকর আর ঠেলাঠেলির সুযোগ নিয়ে মেয়েদের গায়ে হাত বাড়ায়। কেবল হাতই নয়,তারা আবার চাপ সৃষ্টিও করে। পুরুষের চাপেরও আবার নানা রকম আছে। তারা তাদের হাতের কনুই, বাহু, ঊরু, পায়ের পাতা, বুক, নিতম্ব ঠেসে ধরে মেয়েদের গায়ে। লিফটম্যান পুরুষ, সে ভাল জানে পুরুষের স্বভাবচরিত্র। সাপ যেমন জানে সাপের ফণা কাকে বেশি ছোবল দিতে ভালবাসে।
২.
বাসে উঠলেও একটি একলা মেয়ে দেখলে কনডাক্টর কোনও মেয়ের পাশে মেয়েটিকে বসায়, মেয়ে না পাওয়া গেলে বুড়ো পুরুষের পাশে,বড়জোর বাচ্চা কোনও ছেলের পাশে। কনডাক্টর নিজে পুরুষ, সে জানে পুরুষের স্বভাব। তাই সে অথর্ব বা অপ্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের পাশে মেয়েদের বসিয়ে স্বস্তি পায়।
৩.
অবিজ্ঞান মানুষকে ধ্বংস করে, জানি। কিন্তু বিজ্ঞান যাঁরা শেখায়, তাঁরাও আজকাল নতুন প্রজন্মকে ধ্বংস করতে নেমেছে। জগন্নাথ কলেজের কেমেস্ট্রির প্রফেসর নুরুল হক তাঁর ছাত্রছাত্রীদের ধাতুবিদ্যা পড়াতে গিয়ে বলেন—‘বিবাহিত হিন্দু মেয়েরা কপালে সিঁদুর পরে, সিঁদুর হচ্ছে রেড লেড (ট্রাইপ্লামবিক টেট্রোক্সাইড), আর মুসলমান মেয়েরা বিয়ের পর পরে সোনার গয়না। এর কারণ, মেয়েদের শরীর থেকে একধরণের বদ গ্যাস বেরোয়, ওই গ্যাস স্বামীর অমঙ্গল করে। লেড এবং গোল্ড এই গ্যাসকে অ্যাবসর্ব ক’রে নেয়, তাই মেয়েদের ও-সব পরতে হয়’। কিন্তু মেয়েদের শরীর থেকে বের হওয়া বদ গ্যাসটির নাম কী? আমি তো শরীরবিদ্যা ঘেঁটে এমন কোন গ্যাসের খোঁজ পাই নি, যে গ্যাস কেবল মেয়েদের শরীর থেকে নির্গত হয়, পুরুষের শরীরের থকে নয়! কেমেস্ট্রির প্রফেসর কি বিজ্ঞানের ফাঁকে ফাঁকে অবিজ্ঞান শিক্ষা দেবার দায়িত্ব নিয়েছেন? তা না হলে স্বামীর মঙ্গলের জন্য মেয়েদের ত্যাগী হওয়ার এই আদিম ও অসভ্য শিক্ষা তিনি বিতরণ করছেন কেন?
বাসে উঠলেও একটি একলা মেয়ে দেখলে কনডাক্টর কোনও মেয়ের পাশে মেয়েটিকে বসায়, মেয়ে না পাওয়া গেলে বুড়ো পুরুষের পাশে,বড়জোর বাচ্চা কোনও ছেলের পাশে। কনডাক্টর নিজে পুরুষ, সে জানে পুরুষের স্বভাব। তাই সে অথর্ব বা অপ্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের পাশে মেয়েদের বসিয়ে স্বস্তি পায়।
এই সব বদ শিক্ষকেরা বদ গ্যাসের প্রচার করে ছাত্রছাত্রীদের বদ বানাবার চেষ্টায় রত। অলৌকিক অমঙ্গল টেনে তাঁরা লৌ্কিক মঙ্গলকে কায়দা করে দূরে সরিয়ে রাখেন আর একটু-একটু করে বিষ ঢুকিয়ে দেন নতুন প্রজন্মের মস্তিষ্কে।
৪.
মোটর সাইকেলের পিছনের আসনে মেয়েরা একপাশে পা ঝুলিয়ে বসে। দু’দিকে পা রেখে বসলে কিছু কি ক্ষতি হয়? নিশ্চয়ই নয়, বরং যে-কোনও দুর্ঘটনা থেকে তাঁরা বাঁচে বই কী? কিন্তু দু’পা জড়ো করে রাখবার এই নিয়ম কোত্থেকে এল? এও কি আমাদের বেখাপ্পা সমাজ থেকে, যে সমাজে মেয়েদের জড়সড় হয়ে থাকতে হয়, দু’পা-দু’হাত-দু’বাহু প্রসারিত করতে মানা তাদের! যে সমাজে মেয়েরা যত বেশি সিঁটিয়ে থাকবে, তত বাহবা জুটবে তাদের। তাই বুঝি এই বাহবা পাওয়ার লোভে একটি আধুনিক যান ব্যবহার করেও তাকে এই জড়সড় ভঙ্গিটি বজায় রাখতে হয়!
৫.
এক যুবকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। পরিচয়ের তিন দিনের দিন প্রচার হয়ে গেল তার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গেছে, পাঁচ দিনের দিন প্রচার হল একটি বাচ্চাও হয়েছে আমাদের। লোকের ভাবনার ইলাস্টিসিটি দেখে আমি মুগ্ধ হই। সম্ভবত স্ত্রী এবং পতিতার বাইরে কোনও মেয়ে দেখলে পুরুষের চোখের জুলজুল দৃষ্টি আর সরে না। তারা বাঁধভাঙা লোভে মেয়েদের নিয়ে কাহিনি বানায়, যে কাহিনি চায়ের টেবিলে তাদের হাসির জোগান দেয়। মেয়েদের নিয়ে যত রস-রসিকতা ছেলেরা করে, মেয়েরা কি সহস্র ভাগের একভাগ করে?
৬.
বাজারে পাকিস্তানি বোরখার এখন কদর বেশ। মেয়েদের সারা শরীর ঢেকে রাখবার ব্যবস্থা হচ্ছে। এদিকে সিনেমা হলের বিলবোর্ডে মেয়েদের যে পীনোন্নত বুকের শরীর এঁকে পথচারীদের ইন্ধন জোগানো হয় ছবিঘরে যাবার জন্য, সে-সব দেখে ধর্মপ্রাণ মানুষ কেন রুখে দাঁড়ান না, অন্তত যাঁরা মেয়েদের শ্লীলতা রক্ষা করবার জন্য জীবনপাত করছেন! এ-বিষয়ে বিলবোর্ডের দিকে শায়খুল হাদিসই বা কেন এখনও লং মার্চ করছেন না?
৭.
রিকশার হুড তুলে একটি ছেলে চলতে পারে, মেয়ে নয়। একা একটি মেয়ে রিকশার হুড তুললে নাকি দৃশ্যটি শোভন হয় না। এও মেয়েদের ওপর আরেক ধরনের পর্দাপ্রথা। ঢাকা শহরে হঠাৎ হঠাৎ কিছু মেয়েকে দেখা যায় পর্দা ফেলতে, মফস্বলে সম্ভব নয়। মেয়েদের গায়ে তো পর্দা চড়াতেই হয়, ক্লীবলিঙ্গ যানবাহন ও পর্দার ঊর্ধ্বে নয়, যানের পর্দা তার মাথায় তুলতে হয়। বাসেও আলাদা করে বসবার জায়গা থাকে মেয়েদের জন্য। কেবল যানবাহনের নয়, রেস্তোরাঁয় পর্দাঘেরা কেবিন থাকে- কেবিনগুলোর ওপর লেখা থাকে—মহিলা। মেয়েদের
No comments:
Post a Comment