FB LIke Bottom

Friday, November 6, 2015

সম্প্রীতির বান্দরবান ফুলের মালায় ঘরে ফিরলেন ৭৯ ‘বিপ্লবী’ স্ত্রী, চার সন্তান রেখে সশস্ত্র সংগঠন

সম্প্রীতির বান্দরবান
ফুলের মালায় ঘরে ফিরলেন ৭৯ ‘বিপ্লবী’
স্ত্রী, চার সন্তান রেখে সশস্ত্র সংগঠন ন্যাশনাল ম্রো ডিফেন্স পার্টি (এমএনডিপি) গড়তে ঘর ছেড়েছিলেন মেনরুম ম্রো জুনিয়র (৩১)। পাহাড়ে, জঙ্গলে আস্তানা গড়ে দলের কাজ করতে গিয়ে ঘরে ফেরা দূরের কথা, স্ত্রী-সন্তানদের খোঁজও রাখেননি। সাত বছর পর সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে মেনরুম জুনিয়র ফিরে গেছেন নিজের ঘরে।
এমএনডিপি’র কমান্ডার হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন মেনরুম ম্রো। যে লক্ষ্য নিয়ে তিনি ঘর ছেড়েছিলেন, সেই লক্ষ্য পূরণ হয়নি। এমনকি দলের অধিকাংশ সদস্যই বিপথগামী হয়ে যান। অনেকে তাকে ছেড়ে চলে যান।
দলকে এগিয়ে নিতে ব্যর্থ হলেও আত্মসমর্পণের পর মেনরুম ম্রো’র গলায় জুটেছে ফুলের মালা। সেই মালা নিয়েই তিনি ফিরেছেন স্ত্রী-সন্তানদের কাছে।
বৃহস্পতিবার (৫ নভেম্বর) বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলার কুরকপাতা গ্রামে সেনাবাহিনীর আলীকদম জোন (ত্রিশ বীর) আয়োজিত অনুষ্ঠানে মেনরুম ম্রো’র নেতৃত্বে ৭৯ সদস্য আত্মসমর্পণ করেন।
সেখানে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা হয় মেনরুম ম্রো’র। তিনি বলেন, আমি ১৮ বছর বয়সে বিয়ে করি। আমার তিন মেয়ে আর এক ছেলে। ২৫ বছর বয়সে আমি মেনরুম ম্রো সিনিয়রের নেতৃত্বে এমএনডিপিতে যোগ দিই। এরপর পাহাড়ে চলে যাই। আর কোনো দিন ঘরে আসিনি। স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে আর কখনও দেখা হয়নি।
মেনরুম ম্রো’র নেতৃত্বে তার দলে ১২-১৪ বছর বয়সী কিশোর থেকে ২৮-৩০ বছর বয়সী যুবক কিংবা তার চেয়েও বয়স্ক লোকজন আছেন। তাদের অধিকাংশই ঘর ছেড়ে অধিকার আদায়ের নামে পাহাড়ে-জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। শেষপর্যন্ত তারাও ঘরে ফিরেছেন গলায় মালা নিয়ে।
ফাইল হাতে নিয়ে আত্মসমর্পণ করতে আসা মেনরুম জানান, আশির দশকে ম্রো গোষ্ঠী শান্তিবাহিনী থেকে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে বিতাড়িত হন। এরপর থেকে ম্রো সম্প্রদায় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছিল। অধিক নিরাপত্তা এবং সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে তারা সশস্ত্র রাজনৈতিক সংগঠনটি গড়ে তুলেছিলেন। শুরুতেই দলের প্রতিষ্ঠাতা মেনরুম ম্রো সিনিয়র অন্তর্ঘাতী সংঘাতে নিহত হন। একে একে মারা যান কমপক্ষে ২৫ জন।
মেনরুম বাংলানিউজকে বলেন, ‘শুরুতে আমাদের কমপক্ষে ৫০০-৬০০ সদস্য ছিল। অনেকে বিপথগামী হয়ে বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। অনেকে মারা যান। অনেকে দল ছেড়ে দেন। শেষপর্যন্ত আমরা ৭৯ জন আত্মসমপর্ণ করেছি।’
‘আমরা ভুল করেছিলাম। ভুল পথে পা বাড়িয়েছিলাম। মুরাং সোশ্যাল কাউন্সিলের মাধ্যমে আলাপ-আলোচনা করে আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছি। এখন আমরা যেসব দাবি দিয়েছি সেগুলো যেন সরকার সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনায় নেয় সেই অনুরোধ করছি।’ বলেন মেনরুম ম্রো।
মেনরুমের মতো রাইন চং, মাং পং, মেনকৈ ম্রোসহ আরও কয়েকজন বললেন, সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তোলা এবং সেই দলের নামে বিপথগামী হয়ে যাওয়া তাদের ভুল ছিল। সরকার তাদের যে সুযোগ দিয়েছে সেজন্য তারা কৃতজ্ঞ।
মেনরুম জানান, ম্রো সম্প্রদায়ের লোকজনের টাকায় তারা সংগঠন চালাতেন।
তবে কুরুকপাতা গ্রামে ঢোকার সময় সবজি ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলী ও সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন, মূলত অপহরণ এবং চাঁদাবাজিই ছিল এমএনডিপি’র আয়ের প্রধান উৎস। কয়েকদিন আগে তাদের ধরে নিয়ে ৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা মুক্তিপণ আদায় করে তারা। এ বিষয়ে আলীকদম থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উ শৈ সিং বলেছেন, স্বার্থান্বেষী মহল তাদের উসকানি দিয়ে বিভ্রান্ত করে ভুল বুঝিয়ে সশস্ত্র সংগঠন গড়ার পথে ঠেলে দিয়েছিল। কিন্তু ভুল বুঝতে পেরে তারা আত্মঘাতী পথ থেকে ফিরে এসেছে।
আত্মসমর্পণ উপলক্ষে সেনাবাহিনীর আলীকদম জোন আয়োজন করে সম্প্রীতির মুরং সম্মেলন এবং মুরংদের সামাজিকভাবে একত্রীকরণ কর্মসূচির। এতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বীর বাহাদুর এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে এমএনডিপি সামাজিক ধারায় একিভূত হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে এমএনডিপি কমান্ডার মেনরুম ম্রো ১২ দফা দাবি তুলে ধরেন। এতে এমএনডিপি’র সদস্যদের জন্য চাকরি, দলের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের জন্য যাদের সঙ্গে শত্রুতা সৃষ্টি হয়েছে তারা যেন কোনো ধরনের সংকটের সৃষ্টি না করে, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেওয়া, মামলা প্রত্যাহার, ম্রো সম্প্রদায়ের অধিবাসীদের জন্য বাগান লিজ দেওয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
অনুষ্ঠানে প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে এসব দাবি মেনে নেওয়া হবে বলে ঘোষণা দেন।
সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল সফিকুল ইসলাম আত্মসমর্পণকারী সদস্যদের মধ্যে যারা লেখাপড়া ও বাংলা ভাষা জানেন তাদের মধ্যে ৪-৫ জনকে ৩-৪ মাসের মধ্যে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দেন।
তিনি বলেন, ম্রো সম্প্রদায়ের দাবি দাওয়া দেখলাম। আন্তরিকতা এবং সমঝোতার মনোভাব থাকলে এসব দাবি পূরণ কোনো বড় বিষয় নয়। আমরা সেনাবাহিনী পাহাড়ে কর্তৃত্ব করার জন্য আসিনি।

No comments:

Post a Comment