বিরল ভালোবাসা’র দিনলিপি
ঢাকার শ্যামলীতে রাস্তার পাশে তুমুল ঝগড়া হচ্ছে। লোকজন জড়ো হয়ে গেছে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কানে এলো—ঝগড়ার মাঝে উচ্চারিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু আর শেখ হাসিনার নাম। থমকে দাঁড়ালাম। দেখি ছেঁড়া ময়লা শাড়ি পরা এক বৃদ্ধা আর লুঙ্গি পরা এক যুবক শ্যামলী ২ নম্বর রোডের কাজি অফিসের রাস্তার পাশে ঝগড়ায় ব্যস্ত। কিছুক্ষণ ঝগড়া শোনার পর একপর্যায়ে যুবককে উদ্দেশ করে বললাম, ‘আপনারা ঝগড়া করছেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধু আর শেখ হাসিনা আপনাদের কী ক্ষতি করল?’ ঝাঁজালো জবাব দিয়ে দ্রুত চলে গেলেন যুবক।
জানতে পারলাম, বৃদ্ধার নাম রমিজা খাতুন আর যুবকটি আব্দুল কাদির। তাঁরা মা-ছেলে। ছেলে চলে যাওয়ার পর রমিজা ওখানে দাঁড়িয়েই কাঁদতে থাকেন। জড়ো হওয়া কয়েকজন জানালেন, রমিজার স্বামী হাসমত আলী ছেলের নামে জমি না রেখে শেখ হাসিনার নামে রেখেছেন বলে ছেলে কাদির মাকে ভাত-কাপড় দেয় না।
চমকে উঠলাম। শেখ হাসিনার নামে জমি রেখেছেন মানে! বিদ্যুচ্চমকের মতো মাথায় খেলল সাংবাদিকতার সূত্র। ‘শেখ হাসিনার নামে যে জমি রেখেছেন তার কোনো প্রমাণ আছে কি?’
বৃৃদ্ধা রমিজা কোমরে গুঁজে রাখা একটা দলিলের কপি বের করে দেখালেন। দেখি দলিলের গ্রহীতার স্থানে লেখা : ‘শেখ হাসিনা, পতি-ওয়াজেদ আলী, সুধা সদন, ধানমণ্ডি, ঢাকা’।
পেয়ে গেলাম নিউজের রত্ন। রমিজা খাতুনকে বললাম, ‘চলুন, আপনার বাসায় গিয়ে কথা বলি।’ রমিজা বললেন, ‘বাবা, আমি খামু কী? ভিক্ষা না করলে তো পেটের ভাত জুটব না।’ বললাম, ‘ভিক্ষা করে দিনে কত পান?’ রমিজা জানালেন, ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। পকেট থেকে ২০০ টাকা বের করে তাঁর হাতে দিয়ে বললাম, ‘আপনার বাসায় চলেন, আজ আর ভিক্ষা করতে হবে না।’
বস্তির ছোট্ট খুপরি ঘরটিতে গিয়ে বসে গল্প জুড়ে দিই রমিজার সঙ্গে। সব জেনেবুঝে হতবাক হয়ে যাই। রমিজার স্বামী হাসমত আলী রিকশাভ্যান চালিয়ে তিলে তিলে জমানো টাকা দিয়ে নিজের নামে নয়, একমাত্র সন্তান আব্দুল কাদির কিংবা স্ত্রী রমিজা খাতুনের নামেও নয়, ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে একখণ্ড জমি কিনে রেখে গেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা ‘এতিম’ শেখ হাসিনার নামে!
গফরগাঁওয়ের সেই গ্রামে প্রধানমন্ত্রীর বানিয়ে দেওয়া বাড়ির সামনে রমিজা খাতুন
২০১০ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসার এমন বিরল ঘটনা জেনে আমার দিশাহারা অবস্থা। কাউকে কিছু বললাম না; ছুটলাম গফরগাঁওয়ে। সেখানকার সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে খোঁজ নিলাম শেখ হাসিনার নামে করা দলিলটির নম্বর আর মূল ভলিউমের দলিলের নম্বর ঠিক আছে কি না। ২০০ টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে একজনকে খোঁজ নিতে পাঠাই। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে এসে এক কর্মকর্তা জানালেন, হ্যাঁ, সব ঠিক আছে। ৫০০ টাকার বিনিময়ে তুলে নিলাম দলিলের একটি সার্টিফায়েড কপি। সেই কপি হাতে নিয়ে ছুটলাম হাসমত আলীর কেনা জমিতে। পাড়া-প্রতিবেশী ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথাবার্তা বলে, সব কিছু জেনে চলে এলাম ঢাকায়। প্রতিদিনই একটু করে লিখতে থাকলাম। প্রায় দুই মাস পর ২০১০ সালের ২ জুন কালের কণ্ঠে প্রধান প্রতিবেদন হিসেবে ‘বিরল ভালোবাসা’ শিরোনামে ছাপা হলো সেই খবর।
বঙ্গবন্ধু অন্তপ্রাণ গফরগাঁওয়ের ভ্যানচালক হাসমত আলী শুধু মিছিল-মিটিংয়ে ছুটে বেড়িয়েই ক্ষান্ত ছিলেন না; ১৯৭৫-এর হত্যাযজ্ঞের পর বঙ্গবন্ধুর ‘এতিম’ মেয়েদের নিয়ে তিনি ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েন। সারা জীবনের জমানো টাকা দিয়ে গফরগাঁওয়ের রাওনা ইউনিয়নের খারুয়া বড়াইল গ্রামে সাত শতক জমি কেনেন শেখ হাসিনার নামে। শেষ জীবনে এসে ভয়ানক ব্যাধির সঙ্গে লড়াই করে টাকার অভাবে বিনা চিকিত্সায় মারা গেছেন হাসমত, তবু বেচেননি ‘মেয়ে হাসিনার’ নামে কেনা জমিটি। হাসমত আলী মারা যাওয়ার আগে জমির দলিলটি স্ত্রী রমিজা খাতুনের হাতে তুলে দিয়ে বলে যান, যে করেই হোক দলিলটি যেন শেখ হাসিনার হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়।
স্বামীর মৃত্যুর পর রমিজা অথই সাগরে পড়ে যান। শেষ পর্যন্ত ভিক্ষার থালা তুলে নেন হাতে। ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির চারপাশে ভিক্ষা করেন আর স্বামীর রেখে যাওয়া জমির দলিলটি শেখ হাসিনার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে না।
বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিরল ভালোবাসার এই প্রতিবেদন সারা দেশে আলোড়ন তোলে। সেদিন খুব ভোর থেকে আমার মোবাইলে একের পর এক ফোন আসতে থাকে, মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের। কেউ রমিজার দায়িত্ব নিতে চান, কেউ সহযোগিতা করতে চান।
স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আবেগাপ্লুত হন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তাঁর বিশেষ সহকারী সেলিমা খাতুন (তত্কালীন প্রধানমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব-২) রমিজা খাতুনের খোঁজ নেন এবং রমিজা ও আমার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কথা বলবেন বলে জানান।
প্রতিবেদন প্রকাশের পরদিন ৩ জুন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অবশেষে শেখ হাসিনার দেখা পেলেন রমিজা খাতুন। রমিজাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন প্রধানমন্ত্রী। ঘোষণা দিলেন, হাসমত আলীর কেনা জমিটি রমিজা খাতুনের নামে লিখে দেবেন, সেখানে একটি বাড়ি বানিয়ে দেবেন আর রমিজার পুরো জীবনে
FB LIke Bottom
Tuesday, January 12, 2016
বিরল ভালোবাসা’র দিনলিপি ঢাকার শ্যামলীতে রাস্তার পাশে তুমুল ঝগড়া হচ্ছে। লোকজন জড়ো হয়ে গেছে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কানে এলো—ঝগড়ার মাঝে উচ্চারিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু আর শেখ হাসিনার নাম।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment