তিন তরুণের একি নিষ্ঠুরতা
চাকরি ছেড়ে নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রামের বাড়িতে ফেরার মনস্থির করছিলেন তিন তরুণ। তিনজনের বাড়ি নেত্রকোনার কলমাকান্দার ঘোড়াগাঁওয়ে। তবে তাদের কারও হাতেই বাসভাড়া ছিল না। তাই তিন তরুণ ঠিক করলেন, বাস ভাড়া নেই তো কী হয়েছে; বাড়ি ফিরবেন প্রাইভেটকারে। আর চালককে ভাড়া না মিটিয়ে হত্যা করে কৌশলে পালিয়ে যাবেন। নির্মম এই ঘটনা ঘটিয়েছেন আজহারুল ইসলাম (১৯), মোফাজ্জল হোসেন (২০) ও মাসুদ রানা নামের তিন তরুণ। পাঁচ হাজার টাকা ভাড়া নির্ধারণ করে প্রাইভেটকারে বাড়ি ফিরে চালক মো. জাহাঙ্গীরকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেন তারা। বাঁশঝাড়ের মধ্যে লাশ লুকিয়ে রেখে চলে যান। আর প্রাইভেটকারটি (ঢাকা মেট্রো-খ-১১-১৩৫১) ফেলে রাখলেন কংস নদের তীরে। এর পর স্বাভাবিক জীবনও শুরু করলেন তারা।
তবে অপরাধী যে কোনো না কোনো সূত্র রেখে যায়। আর সেই সামান্য সূত্র ধরেই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) লোমহর্ষক এই হত্যার সঙ্গে জড়িত চক্রটিকে শনাক্ত করেছে। আজহারুল ও মোফাজ্জলকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই তারা হত্যাকাণ্ডের আদ্যোপান্ত বর্ণনা করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। মামলার সাক্ষী হিসেবে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন আজহারুলের চাচাতো ভাই শাহীন। এখন পুলিশ খুঁজছে মাসুদ রানাকে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ডিসি (পূর্ব) মাহবুব আলম সমকালকে বলেন, পাঁচ হাজার টাকার কারণে একই গ্রামের তিন তরুণ প্রাইভেটকার চালককে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। চালক নিজে প্রাইভেটকারটির মালিক ছিলেন। গাড়িটি চালিয়ে তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন।
হত্যার সঙ্গে জড়িত দু'জনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির সূত্রে জানা যায়, গত ৩০ নভেম্বর মাসুদ রানার সঙ্গে গ্রামের বাড়ি থেকে নারায়ণগঞ্জে এসে মৌসুমী ফ্যাশনে মাসে চার হাজার ১০০ টাকা বেতনে তৈরি পোশাক কারখানায় চাকরি নেন আজহারুল ও মোফাজ্জল। মাসুদ একই এলাকায় আগে থেকে পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। তবে চাকরি পাওয়ার একদিন পরই তা ছেড়ে দিয়ে বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন আজহারুল ও মোফাজ্জল। বাড়ি যাওয়ার খরচ হাতে না থাকায় তিন তরুণ মিলে একজন সিএনজি চালকের মাধ্যমে প্রাইভেটকার ভাড়া করেন। গত ২ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর সবুজবাগের বাসিন্দা কারচালক জাহাঙ্গীর নারায়ণগঞ্জের তারাব এলাকা থেকে আজহারুল, মোফাজ্জল ও রানাকে নিজের গাড়িতে তোলেন।
ভোররাতে তারা নেত্রকোনার পূর্বধলা থানাধীন হুগলা ইউনিয়নের জামিয়াকান্দা গ্রামে পেঁৗছার পর তিন তরুণ চালককে গাড়ি থামানোর অনুরোধ করেন। গাড়ি চালানো বন্ধ করার পরপর চালকের পেছনে আসনে বসা মাসুদ রানা প্রথমে রশি দিয়ে জাহাঙ্গীরের গলায় ফাঁস দেন। এর পর তার দুই সহযোগী গলা চেপে ধরেন। চালকের মৃত্যু নিশ্চিত হলে রাতের অন্ধকারে ঘটনাস্থলের অদূরে একটি বাঁশঝাড়ের মধ্যে লাশটি ফেলে দেন। মাসুদ রানা প্রাইভেটকার চালিয়ে ঘটনাস্থল থেকে অন্তত সাত কিলোমিটার দূরে কংস নদের তীরে নিয়ে ফেলে রাখেন। এর পর ওই রাতে আজহারুল পাশের এলাকার বাসিন্দা তার চাচাতো ভাই শাহীনকে ফোনকে করে দেড়শ' টাকা ঋণ নেন। তিন বন্ধু ফেরেন নিজ নিজ বাড়িতে। ঘটনার কয়েক দিন পর মাসুদ ঢাকায় ফিরে এলেও আজহারুল ও মোফাজ্জল গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করেন। ৭ ডিসেম্বর অর্ধগলিত অবস্থায় জামিয়াকান্দা গ্রাম থেকে একটি লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। দীর্ঘদিন পরও পরিচয় শনাক্ত করতে না পারায় ওই মরদেহ অজ্ঞাত লাশ হিসেবে দাফন করে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম।
পুলিশ জানায়, জাহাঙ্গীর বাড়ি ফিরে না আসায় ও মোবাইল ফোনসেট বন্ধ থাকায় তার স্ত্রী শিখা বেগম রাজধানীর সবুজবাগ থানায় জিডি করেন। ওই জিডির সূত্র ধরে তদন্ত করে ডিবি। এর পর মোবাইল ফোনের কললিস্টের সূত্র ধরে প্রথমে সন্দেহভাজন হিসেবে নেত্রকোনা থেকে আটক করা হয় আজহারুলের চাচাতো ভাই শাহীনকে। শাহীনকে জিজ্ঞাসাবাদ করার মধ্য দিয়ে অপর তিনজনের নাম বেরিয়ে আসে। শাহীন জানান, ওই রাতে আজহারুল, মোফাজ্জল ও মাসুদ রানা তার সঙ্গে দেখা করে দেড়শ' টাকা নিয়েছিলেন। এর পর ১৮ ডিসেম্বর আজহারুল ও মোফাজ্জলকে গ্রেফতার করা হলে তারা হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের খিলগাঁও বিভাগের সহকারী কমিশনার ইকবাল হোসেন সমকালকে বলেন, যে কারণে একজন চালককে হত্যা করা হয়েছে, সেটা অচিন্তনীয় ব্যাপার। জাহাঙ্গীর নিখোঁজের ঘটনায় প্রথমে সবুজবাগ থানায় যে জিডি হয়েছিল, তা এখন হত্যা মামলায় রূপান্তর হয়েছে। এখন মামলাটির তদন্ত করছে ডিবি।
ডিবির পরিদর্শক সাখাওয়াত হোসেন বলেন, জাহাঙ্গীরের হত্যার সঙ্গে জড়িতদের গাড়ি ছিনতাইয়ের কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। কারণ, চালককে হত্যার পর গাড়িটি তারা কংস নদের পাড়ে অসীম কুমার সিংহের বাড়ির পাশে খালি জায়গায় রেখে দেয়। দু'জনকে গ্রেফতারের পর তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরিত্যক্ত অবস্থায় গাড়িটি উদ্ধার করা হয়েছে। ভাড়ার পাঁচ হাজার টাকা না দিয়ে চালককে মারধর করেও তিন তরুণ পালাতে পারত।
FB LIke Bottom
Monday, January 11, 2016
তিন তরুণের একি নিষ্ঠুরতা চাকরি ছেড়ে নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রামের বাড়িতে ফেরার মনস্থির করছিলেন তিন তরুণ।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment